বাংলাদেশে পুরুষদের হাইপোগোনাডিজম (লো টেস্টোস্টেরন): কারণ, উপসর্গ ও চিকিৎসা
পরিচিতি
টেস্টোস্টেরন হলো পুরুষদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হরমোন, যা শক্তি, পেশি, মেজাজ ও যৌন স্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। যখন শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা স্বাভাবিকের নিচে নেমে যায়, তখন পুরুষরা ক্লান্তি, যৌন আগ্রহ কমে যাওয়া, পেশিশক্তি হ্রাস, কিংবা মনোযোগের অভাবের মতো পরিবর্তন অনুভব করেন।
এই অবস্থাকে বলা হয় Male Hypogonadism, অর্থাৎ টেস্টিস পর্যাপ্ত টেস্টোস্টেরন উৎপাদন করতে না পারা বা মস্তিষ্ক থেকে সঠিক সংকেত না পাওয়া।
বাংলাদেশে অনেক পুরুষ এই সমস্যা উপেক্ষা করেন, ধরে নেন এটা বয়স বা মানসিক চাপের কারণে হচ্ছে। অথচ অল্প বয়সীদের মধ্যেও ঘুমের ঘাটতি, স্থূলতা ও দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেসের কারণে টেস্টোস্টেরন কমে যাচ্ছে। সুখবর হলো — এটি সহজে শনাক্ত করা যায় এবং সঠিক চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
Male Hypogonadism কী?
Male Hypogonadism তখন হয় যখন শরীর পর্যাপ্ত টেস্টোস্টেরন উৎপাদন করতে পারে না। প্রায় ৯৫% টেস্টোস্টেরন উৎপন্ন হয় টেস্টিসে, আর বাকিটা আসে কিডনির উপরে অবস্থিত অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে। যদি এই অঙ্গগুলোর কাজ ব্যাহত হয়, তাহলে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয় — যার প্রভাব পড়ে শরীর ও মনের ওপর।
টেস্টোস্টেরন পুরুষদের শরীরে বৈশিষ্ট্য তৈরি করে — যেমন বীর্য উৎপাদন, মুখে দাড়ি-গোঁফ, শক্তিশালী পেশি ও ভারী কণ্ঠস্বর। এর ঘাটতি হলে দেখা দেয় যৌন আগ্রহ কমে যাওয়া, দুর্বলতা ও আত্মপ্রেরণার অভাব। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস, স্থূলতা ও দীর্ঘ সময় কাজের চাপের কারণে এই হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ক্রমেই বাড়ছে — বিশেষ করে ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যে।
স্বাভাবিক টেস্টোস্টেরনের মাত্রা
টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বয়স, স্বাস্থ্য ও পরীক্ষার পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে।
- স্বাভাবিক সীমা: ৩০০–১০০০ ng/dL (সকালের রক্ত পরীক্ষায়)
- তরুণ (২০–৪০ বছর): সাধারণত ৬০০–৯০০ ng/dL
- ৬৫ বছরের বেশি বয়সে: প্রায় ৫০০–৮০০ ng/dL
দুটি সকালের রক্ত পরীক্ষায় টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কম এবং উপসর্গ মিলে গেলে হাইপোগোনাডিজম নির্ণয় করা হয়। ৩০ বছর বয়সের পর থেকে প্রতি ১০ বছরে প্রায় ১০০ ng/dL করে টেস্টোস্টেরন কমতে থাকে। নিয়মিত পরীক্ষা করলে পরিবর্তনগুলো দ্রুত বোঝা যায়।
বাংলাদেশে ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বে প্রায় চার জনে একজন পুরুষের টেস্টোস্টেরনের ঘাটতি থাকতে পারে, যদিও সচেতনতার অভাবে খুব কম মানুষই চিকিৎসা নেন।
সাধারণ উপসর্গ
টেস্টোস্টেরন পুরুষদের শক্তি, মেজাজ, যৌন ক্ষমতা ও প্রজননের জন্য অপরিহার্য। এর ঘাটতি ধীরে ধীরে দেখা দেয় এবং অনেক সময় অজান্তেই উপেক্ষিত হয়।
সাধারণ উপসর্গসমূহ:
- যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া বা দুর্বল ইরেকশন
- সকালে ইরেকশন না হওয়া
- স্থায়ী ক্লান্তি বা শক্তির অভাব
- পেশি ক্ষয় বা দুর্বলতা
- টেস্টিস ছোট হয়ে যাওয়া
- চুল ঝরে যাওয়া
- মেজাজের ওঠানামা বা বিরক্তি
- বীর্যের মান বা পরিমাণ কমে যাওয়া
অন্যান্য উপসর্গ:
- বিষণ্নতা বা মনোযোগে ঘাটতি
- পেটের চর্বি বা ওজন বৃদ্ধি
- সহনশক্তি কমে যাওয়া
- বুকের মেদ বৃদ্ধি (Gynecomastia)
- রক্তস্বল্পতা (Anemia)
কিশোরদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরনের ঘাটতি যৌবন বিলম্বিত করে বা যৌনাঙ্গের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে। চিকিৎসা না নিলে দীর্ঘস্থায়ী হাইপোগোনাডিজম থেকে অস্টিওপোরোসিস, হৃদরোগ ও মেটাবলিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
পুরুষদের হাইপোগোনাডিজমের কারণ
Male Hypogonadism ঘটে যখন শরীর পর্যাপ্ত টেস্টোস্টেরন উৎপাদন করতে পারে না। এর পেছনে থাকে টেস্টিসের সমস্যা অথবা মস্তিষ্কের হরমোন নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়া:
হাইপোথ্যালামাস থেকে GnRH হরমোন নিঃসৃত হয়, যা পিটুইটারি গ্রন্থিকে FSH ও LH হরমোন উৎপাদনে উদ্দীপিত করে।
FSH বীর্য উৎপাদনে সাহায্য করে এবং LH টেস্টিসকে টেস্টোস্টেরন উৎপাদনে প্ররোচিত করে।
এই শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটলে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে যায়।
দুই ধরণের হাইপোগোনাডিজম:
- প্রাইমারি (Primary): টেস্টিসের সমস্যা
- সেকেন্ডারি (Secondary): মস্তিষ্কের হরমোন সংকেতের সমস্যা
কারণ হতে পারে জন্মগত (Genetic) বা অর্জিত (Acquired)।
প্রাইমারি হাইপোগোনাডিজমের কারণ
- Klinefelter Syndrome: অতিরিক্ত X ক্রোমোজোমের উপস্থিতি
- Undescended Testicle: জন্মের পর টেস্টিস স্বাভাবিকভাবে না নামা
- Mumps Orchitis: মাম্পস ভাইরাসের কারণে টেস্টিসে প্রদাহ
- Cancer Treatment: কেমোথেরাপি বা হরমোন থেরাপির প্রভাব
- Aging: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হরমোনের স্বাভাবিক পতন
- Hemochromatosis: শরীরে অতিরিক্ত লোহা জমে টেস্টিস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া
সেকেন্ডারি হাইপোগোনাডিজমের কারণ
- জন্মগত হরমোন সমস্যা (GnRH বা LH নিঃসরণে ব্যাঘাত)
- Kallmann Syndrome: যৌবন বিলম্বিত করে এমন জেনেটিক সমস্যা
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা পুষ্টির ঘাটতি
- Pituitary Tumor: মস্তিষ্কের হরমোন নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলে
- Brain Injury বা Infection: হরমোন উৎপাদক গ্রন্থি ক্ষতিগ্রস্ত করে
- Anabolic Steroid Abuse: দীর্ঘদিন স্টেরয়েড ব্যবহারে শরীরের প্রাকৃতিক টেস্টোস্টেরন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে
- Severe Head Trauma: পিটুইটারি গ্রন্থির ক্ষতি ঘটায়
ঝুঁকির কারণ
যেকোনো পুরুষের হাইপোগোনাডিজম হতে পারে, তবে কিছু অবস্থায় ঝুঁকি বেশি থাকে। বাংলাদেশে স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ প্রধান কারণ।
মূল ঝুঁকি উপাদান:
- জেনেটিক হরমোনজনিত ব্যাধি
- স্থূলতা (Obesity) — সবচেয়ে সাধারণ কারণ
- টাইপ ২ ডায়াবেটিস
- বয়স বৃদ্ধি
- দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা বা অপুষ্টি
- কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপি
- ড্রাগ বা স্টেরয়েডের অপব্যবহার
- HIV সংক্রমণ বা দীর্ঘ রোগভোগ
- হরমোনজনিত বন্ধ্যত্ব
স্থূলতা ও হরমোন ঘাটতি একে অপরকে বাড়িয়ে তোলে — চর্বি বাড়লে টেস্টোস্টেরন কমে, আর কমে গেলে চর্বি বাড়ে।
নির্ণয় (Diagnosis)
হাইপোগোনাডিজম নির্ণয়ের প্রথম ধাপ হলো উপসর্গ বোঝা — যেমন ক্লান্তি, যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া, পেশিশক্তি হ্রাস ইত্যাদি। এরপর একজন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট বা ইউরোলজিস্ট রক্ত পরীক্ষা ও শারীরিক মূল্যায়ন করেন।
মূল ধাপগুলো:
- পারিবারিক ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ইতিহাস
- শারীরিক পরীক্ষা
- জীবনধারা, ওষুধ ও উপসর্গ বিশ্লেষণ
প্রয়োজনে Androgen Deficiency in Aging Males (ADAM) প্রশ্নাবলী ব্যবহার করা হয় উপসর্গ মূল্যায়নে।
গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা:
- সকালের দুইবার টেস্টোস্টেরন টেস্ট (৮–১০টা)
- FSH, LH
- থাইরয়েড, ভিটামিন D ও আয়রন প্রোফাইল
- PSA টেস্ট থেরাপি শুরুর আগে
প্রয়োজনে MRI, Semen Analysis বা Genetic Test করা হয় তরুণ রোগীদের ক্ষেত্রে।
চিকিৎসা (Treatment)
চিকিৎসা নির্ভর করে কারণ ও উপসর্গের তীব্রতার ওপর। অনেক ক্ষেত্রেই জীবনধারার পরিবর্তনই যথেষ্ট, আবার কারও ওষুধ প্রয়োজন হয়।
প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি:
১. Testosterone Replacement Therapy (TRT)
ক্যাপসুল, জেল, প্যাচ, ইনজেকশন বা পিলেট আকারে দেওয়া হয়। এটি শক্তি, মেজাজ ও যৌন সক্ষমতা বাড়ায়, তবে বীর্য উৎপাদন কমাতে পারে। সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা থাকলে বিকল্প চিকিৎসা দরকার।
২. Clomiphene Citrate
শরীরের নিজস্ব টেস্টোস্টেরন উৎপাদন বাড়ায়, কিন্তু প্রজননে প্রভাব ফেলে না।
৩. Enclomiphene Citrate
Clomiphene-এর মতোই কাজ করে, কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম।
৪. Anastrozole
টেস্টোস্টেরন থেকে ইস্ট্রোজেন রূপান্তর বন্ধ করে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখে।
৫. Human Chorionic Gonadotropin (hCG)
ইনজেকশন আকারে দেওয়া হয়, যা প্রাকৃতিক টেস্টোস্টেরন উৎপাদন বাড়ায় এবং বীর্যমান রক্ষা করে।
বাংলাদেশে এসব চিকিৎসা এখন এন্ডোক্রাইনোলজি ও পুরুষ স্বাস্থ্য ক্লিনিকে পাওয়া যায়। চিকিৎসা অবশ্যই বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে নিতে হবে।
প্রতিরোধ (Prevention)
সব ক্ষেত্রে হাইপোগোনাডিজম প্রতিরোধ সম্ভব নয়, তবে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস ঝুঁকি কমায়। ওজন নিয়ন্ত্রণ, পর্যাপ্ত ঘুম, সুষম খাদ্য ও মানসিক ভারসাম্য টেস্টোস্টেরন রক্ষায় সহায়ক।
প্রতিরোধের উপায়:
- ফল, সবজি ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খান
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন
- পর্যাপ্ত ঘুমান (৭–৮ ঘণ্টা)
- চিনি, অ্যালকোহল ও জাঙ্ক ফুড কমান
- ধূমপান ও স্টেরয়েড এড়িয়ে চলুন
- মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন
- বছরে অন্তত একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন
উপসর্গ যেমন ক্লান্তি, মন খারাপ, বা যৌন আগ্রহ কমে যাওয়া টের পেলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসা পুরুষদের শক্তি, আত্মবিশ্বাস ও প্রজনন ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে পারে।