বাংলাদেশে রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন (Retrograde Ejaculation): কারণ, উপসর্গ, নির্ণয় ও চিকিৎসা
বেশিরভাগ পুরুষই এ বিষয়ে কথা বলতে চান না, কিন্তু বীর্যপাতজনিত সমস্যা আসলে অনেক বেশি সাধারণ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অকাল বীর্যপাত, বীর্যপাত বিলম্ব, এবং অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত একটি অবস্থা — রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন। রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন তখন ঘটে যখন বীর্যপতনের সময় বীর্য লিঙ্গের আগা দিয়ে বের না হয়ে মূত্রথলিতে ফিরে যায়। এটি সাধারণত “ড্রাই অর্গাজম” হিসেবে ধরা পড়ে এবং সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনায় থাকা দম্পতিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। অনেক সময় শারীরিক অস্বস্তি না থাকলেও এটি ডায়াবেটিস, স্নায়ু ক্ষতি, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা পেলভিক সার্জারির পরবর্তী প্রভাব নির্দেশ করতে পারে। সচেতনতা পুরুষের প্রজনন স্বাস্থ্য ও মানসিক আত্মবিশ্বাস দুটোই সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক।
রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন কী?
রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন এমন একটি অবস্থা যেখানে বীর্য লিঙ্গ দিয়ে বের না হয়ে মূত্রথলিতে ফিরে যায়। এতে বাহ্যিক বীর্যপাতের পরিমাণ কমে বা অনুপস্থিত থাকে, যদিও অর্গাজমের অনুভূতি সাধারণত স্বাভাবিক থাকে। স্বাভাবিকভাবে বীর্য তৈরি হয় অণ্ডকোষের শুক্রাণু এবং সেমিনাল ভেসিকল ও প্রোস্টেটের তরলের সমন্বয়ে; এগুলো ইউরেথ্রা দিয়ে বের হয়। অর্গাজমের সময় ব্লাডার নেক (bladder neck) পেশী বন্ধ হয়ে বীর্যকে মূত্রথলিতে ফিরে যেতে বাধা দেয়। যখন এই পেশীর টোন বা স্নায়ু-নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হয়, বীর্য মূত্রথলিতে মিশে যেতে পারে — ফলে বাহ্যিক বীর্যপাত কমে যায় এবং অর্গাজম-পরবর্তী মূত্র ঘোলা দেখা দিতে পারে।
রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন কতটা সাধারণ?
অবস্থা তুলনামূলকভাবে বিরল, তবে প্রায়ই চিকিৎসা না নেওয়া বা লজ্জার কারণে শনাক্ত কম হয়। বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি ডায়াবেটিস রোগী, প্রোস্টেট/ব্লাডার সার্জারি করা ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ ব্যবহারকারীদের মধ্যে এটি তুলনামূলক বেশি দেখা যায়। শারীরিকভাবে ক্ষতিকর নয় হলেও সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনায় থাকা দম্পতিদের জন্য এটি মানসিক চাপের উৎস হতে পারে—সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাধানযোগ্য।
উপসর্গ
সাধারণ লক্ষণসমূহ:
- অর্গাজমের সময় বাহ্যিক বীর্যপাত অনুপস্থিত বা অস্বাভাবিকভাবে কম (“ড্রাই অর্গাজম”)
- অর্গাজম-পরবর্তী প্রস্রাব ঘোলা দেখা যেতে পারে
- সন্তান ধারণে সমস্যা, যদিও অর্গাজমের অনুভূতি ও যৌন আনন্দ সাধারণত স্বাভাবিক
অবস্থা সাধারণত ব্যথাহীন এবং ইরেকশনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে না; তবে বারবার ব্যর্থতা বা বীর্যপাত কমে যাওয়ার অনুভূতিতে উদ্বেগ/চিন্তা তৈরি হতে পারে।
কেন হয়: প্রধান কারণসমূহ
রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন সাধারণত ব্লাডার নেক পেশীর টোন কমে যাওয়া বা স্নায়ু-সংকেতের ব্যাঘাতে ঘটে। কারণগুলোর মধ্যে ওষুধ, সার্জারি এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ গুরুত্বপূর্ণ।
১) ওষুধের প্রভাব
বাংলাদেশে প্রচলিত কিছু ওষুধ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বীর্যপাতের পথে প্রভাব ফেলতে পারে:
- অ্যালফা-ব্লকারস (BPH/উচ্চ রক্তচাপ): যেমন Tamsulosin, Silodosin
- কিছু অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট (SNRI): যেমন Venlafaxine (Effexor®)
- অ্যান্টিসাইকোটিকস: যেমন Risperidone, Clozapine, Thioridazine
নতুন ওষুধ শুরুর পর উপসর্গ দেখা দিলে নিজে থেকে বন্ধ না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
২) সার্জারির প্রভাব
প্রোস্টেট/ব্লাডার/পেলভিক অঞ্চলের সার্জারির পর বীর্যপাতের স্বাভাবিক পথ ব্যাহত হতে পারে:
- TURP বা HoLEP (BPH সার্জারি) — বীর্যপাতে প্রভাব ফেলতে পারে
- ব্লাডার বা ক্যান্সার সার্জারি — মূত্রথলি/প্রজনন স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি
- স্পাইন/পেলভিক সার্জারি — স্নায়ু সংকেতের ব্যাঘাত
সার্জারির আগে সম্ভাব্য যৌন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে ইউরোলজিস্টের সাথে আলোচনা করুন।
৩) দীর্ঘস্থায়ী রোগ
কিছু দীর্ঘমেয়াদি রোগ স্নায়ু বা পেশীর নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করে:
- ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি)
- মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (MS)
- স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি/স্ট্রোক
- কিছু জন্মগত গঠনগত ত্রুটি
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
ঝুঁকি ফ্যাক্টর (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট)
দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস, প্রোস্টেট বা পেলভিক সার্জারির ইতিহাস, এবং আলফা-ব্লকারসহ কিছু ওষুধ ব্যবহারে রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশনের ঝুঁকি বাড়ে। TURP/HoLEP-পরবর্তী রোগীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশে বীর্যপাতের ধরনে পরিবর্তন দেখা যায়। সঠিক অপারেশন-পদ্ধতি নির্বাচন, পূর্ব-পরামর্শ এবং নিয়মিত ফলো-আপ ঝুঁকি কমায়।
রোগ নির্ণয় (Diagnosis)
প্রাথমিকভাবে ইউরোলজিস্ট ইতিহাস/শারীরিক পরীক্ষা ও উপসর্গ মূল্যায়ন করেন। নিশ্চিতকরণের জন্য Post-Ejaculate Urinalysis (PEU) করা হয়—অর্গাজমের পরপরই মূত্রের নমুনায় মাইক্রোস্কোপে শুক্রাণু খোঁজা হয়। প্রতি হাই-পাওয়ার ফিল্ডে শুক্রাণু দেখা গেলে রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন নিশ্চিত ধরা হয়। বাংলাদেশের অ্যান্ড্রোলজি/ফার্টিলিটি ক্লিনিকগুলোতে এই পরীক্ষা এবং প্রয়োজনে অতিরিক্ত মূল্যায়ন (যেমন ডায়াবেটিস কন্ট্রোল) করা হয়।

চিকিৎসা (Treatment)
চিকিৎসা নির্ভর করে মূল কারণের ওপর। অনেক ক্ষেত্রে সার্জারি ছাড়াই ওষুধ-সমন্বয়, সহায়ক ওষুধ বা দীর্ঘস্থায়ী রোগ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। বন্ধ্যাত্ব নিয়ে উদ্বেগ থাকলে ফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞের সহযোগিতা নেওয়া হয়।
- ১) ওষুধ পরিবর্তন/সমন্বয়: আলফা-ব্লকার/অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট শুরুর পর উপসর্গ হলে বিকল্প বা ডোজ-সমন্বয়
- ২) সহায়ক ওষুধ: ব্লাডার নেক টোন বাড়াতে Imipramine, Pseudoephedrine, Antihistamine (যেমন Chlorpheniramine), Phenylephrine — চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে
- ৩) অন্তর্নিহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ: ডায়াবেটিস কন্ট্রোল, নিউরোপ্যাথি ম্যানেজমেন্ট
- ৪) সার্জারি (নির্বাচিত ক্ষেত্রে): সীমিত ভূমিকা; সাধারণত প্রথম সারির নয়
| পদ্ধতি | উদ্দেশ্য | কখন উপকারী |
|---|---|---|
| ওষুধ পরিবর্তন/বিকল্প | দোষী ওষুধের প্রভাব কমানো | নতুন ওষুধ শুরুর পর উপসর্গ হলে |
| সহায়ক ওষুধ | ব্লাডার নেক টোন বৃদ্ধি | ড্রাই অর্গাজম/ফার্টিলিটি উদ্বেগ থাকলে |
| দীর্ঘস্থায়ী রোগ নিয়ন্ত্রণ | স্নায়ু সুরক্ষা ও উপসর্গ কমানো | ডায়াবেটিস/নিউরোপ্যাথি থাকলে |
| সার্জারি (বাছাই) | বাছাইকৃত ক্ষেত্রে ফাংশন উন্নতি | অন্য পদ্ধতিতে ফল না মিললে |
বন্ধ্যাত্বের সমাধান (Fertility Options)
সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা থাকলে অ্যান্ড্রোলজি/ফার্টিলিটি স্পেশালিস্টের তত্ত্বাবধানে নিম্নোক্ত পদ্ধতিগুলো বিবেচনা করা হয়:
- IUI/IVF — স্বাভাবিকভাবে সংগৃহীত বীর্য ব্যবহার করে
- IUI/IVF — অর্গাজম-পরবর্তী মূত্র থেকে শোধিত শুক্রাণু ব্যবহার করে
- IVF — প্রয়োজনে অণ্ডকোষ থেকে সার্জারিতে সংগৃহীত শুক্রাণু দিয়ে
ব্যক্তিভেদে পরিকল্পনা ভিন্ন হতে পারে; তাই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অপরিহার্য।
প্রতিরোধ (Prevention)
কারণভিত্তিক প্রতিরোধই সবচেয়ে কার্যকর:
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
- নিয়মিত শরীরচর্চা করা
- চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার কমানো
- তাজা ফল–সবজি ও পূর্ণ শস্য বেশি খাওয়া
- ডায়াবেটিস নিয়মিত মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ
- সার্জারির আগে “ejaculation-sparing” পদ্ধতি/ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসকের সাথে আলোচনা
বাংলাদেশে ডায়াবেটিস ও প্রোস্টেট রোগের হার বাড়ছে—প্রাথমিক চিকিৎসা, জীবনধারা উন্নয়ন এবং সঠিক সার্জিক্যাল পরিকল্পনা যৌন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সহায়ক।